কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবনী | জাতীয় কবি - Educoxbd Jobs

কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবনী | জাতীয় কবি

কাজী নজরুল ইসলাম

 


কজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই বাংলা সাহিত্যে যে বহুমুখী প্রতিভার নাম বলতে পারি তিনি কবি কজী নজরুল ইসলাম ।

রবীন্দ্রনাথের প্রবল প্রতাপের যুগেই তাঁর কাব্যে বিদ্রোহী সুর উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলো। বিদ্রোহী ভাবধারার উত্তুঙ্গ প্রকাশে তাঁর প্রথম কাব্য ‘অগ্নিবীণা' প্রকাশের পূর্বেই তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয় 'বিদ্রোহী' শব্দটি।

তবে নজরুল শুধু বিদ্রোহাত্মক কবিতাই লেখেননি, বিচিত্রবিধ বিপরীত বিষয়ক কবিতায় ঋদ্ধ তাঁর কাব্য জগত। আবেগী কবিতা, সূক্ষ্মতম ইন্দ্রিয়বেদ্য কবিতা, সমাজমনস্ক কবিতা, ব্যঙ্গাত্মক কবিতা, প্রেমের কবিতা, লিরিক কবিতা, কাহিনী কাব্য, সঙ্গীত প্রভৃতি নানাবিধ বিষয় ও প্রকরণ প্রকৌশলে স্বতন্ত্র তাঁর কাব্যধারা। নজরুল পরবর্তী কবিতায় নজরুলের প্রভাব পড়েছে বিপুলভাবে।

বাংলা সাহিত্যের তিরিশ ও চল্লিশের দশকের প্রায় সকল কবিই নজরুলের প্রভাবকে অঙ্গীকার করেই কাব্য রচনা শুরু করেন। পরবর্তী অন্যদের কবিতায় নজরুলের এ বিপুল প্রভাব তাঁর স্বকীয়তারই পরিচায়ক।

কজী নজরুল ইসলাম এর জন্ম-মৃত্যু ও পরিচয়
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৫ মে ১৮৯৯ সালে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।

তার মাতার নাম জাহেদা খাতুন এবং পিতা কাজী ফকির আহমদ। তার পিতা পেশায় মসজিদের ঈমাম ছিলেন। স্ত্রী আশালতা সেনগুপ্তা (ডাক নাম- দুলি, বিবাহোত্তর নাম- প্রমীলা)।

ছোট বেলায় কজী নজরুল ইসলাম এর ঢাক নাম ছিল 'দুখু মিয়া'। বাংলার সাহিত্য সমাজে তার ছদ্মনাম ছিল 'ধুমকেতু'। সাহিত্য জগতে তিনি ’বিদ্রোহী কবি’ এবং বাংলা গানের জগতে ’বুলবুল’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি বাক শক্তি হারান। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং 'বাংলাদেশের জাতীয় কবি' উপাধিতে ভূষিত করেন।

কজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের ২৯ এ আগস্ট (১২ ই ভাদ্র ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) 'পিক্স ডিজিজ' রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়।

শিক্ষা জীবন :

মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে পরিবারের অভাব অনটনের কারণে নজরুলের শিক্ষা জীবন ব্যাপক ভাবে ক্ষিতিগ্রস্ত হয়। তবে চকরি জীবনে বিভিন্ন লোকের সংস্পর্শে নানা সময়ে নানা শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে ঠিকই কিন্তু ৮ম শ্রেণীর গন্ডি পেরোনো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে একাডেমিক শিক্ষা সম্ভব না হলেও নজরুল তার জ্ঞান চর্চা অভ্যহত রেখেছিলেন। চাকরির সুবাধে তিনি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃির মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে তিনি বাংলা ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, ফার্সি ভাষায় দিক্ষিত হয়েছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম এর কর্ম জীবন:

নজরুলের কর্ম জীবন ছিল এক বৈচিত্রময় অধ্যায়। ১৯০৯ সালে মাত্র ৯ বছর বয়েসে বাবাকে হারানোর পর জীবিকার তাগিদে তিনি নানবিদ পেশায় জড়িয়েছেন।

মাত্র ১০ বছর বয়সে মক্তব হতে নিম্ন মাধ্যমিক পাস করে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন পাশাপাশি মসজিদে মোয়াজ্জিনের দ্বায়িত্ব পালন করেন। ফলে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন যা পরবর্তীতে তার সাহিত্যকর্মকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। বলা যায় নজরুলই বাংলা সাহিত্যে প্রথম ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন।

এর পর তিনি লেটোর যাত্রাদলে যোগদেন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি নাট্যদলের জন্য বেশ কিছু লোক সঙ্গীত রচনা করেন। কর্ম জীবনের এক পর্যায়ে তিনি আসানসোলে রুটি বনানোর কাজ করেছিলেন। এভাবেই অনেক কষ্টের মাঝে তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিল।

সেনাবাহিনীতে যোগদান :

১ম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৭ সালে কাজী নজরুল ইসলাম ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিলেন। প্রায় আড়াই বছর সামরিক জীবনে তিনি সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত পদন্নোতি লাভ করেছিলেন।

সেবাহিনীতে থাকা অবস্থায় পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষার শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়া সহকর্মীদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে সঙ্গীতের চর্চা করতেন। এ সময় কাজের ফাঁকে তিনি গদ্য-পদ্যের চর্চাও অব্যাহত রাখেন। নজরুল করাচি সেনানিবাসে কর্মরত থাকাকালীন তার প্রথম গদ্য (বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী) এবং প্রথম প্রকাশিত কবিতা (মুক্তি) রচনা করেন।

এই সময় তিনি বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের বই পড়তেন (যেমনঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফার্সি কবি হাফিজ)। তাই বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি হয়েছিল করাচির সেনানিবাসেই। ১৯২০ সালে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ায় তিনি সৈনিক জীবন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন।

সাংবাদিক জীবন: 

কাজী নজরুল ইসলাম সৈনিক জীবন শেষে ১৯২০ সালে 'নবযুগ' নামক একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। তখন এই পত্রিকার উপজীব্য বিষয় ছিল অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক।

নবযুগ পত্রিকার মাধ্যমেই কজী নজরুল ইসলাম সাংবাদিক হিসেবে তার যাত্রা শুরু করেন। সাংবাদিকতার সুবাদে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্তিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পান। তার বিদ্রহী লেখিনিতে 'দৈনিক নবযুগ' পত্রিকাটি খুব দ্রত জনপ্রিয়তা লাভ করে।  বিদ্রহী ভাবধারার লেখনির জন্য ব্রিটিশ সরকার নবযুগ পত্রিকাটিকে দুই-তিন বার সতর্ক করে।

নবযুগ ছাড়াও নজরুল যে পত্রিকাগুলোতে কাজ করে সেগুলো হলো ধূমকেতু (১৯২২), লাঙ্গল (১৯২৫), গণবাণী।

কজী নজরুল ইসলাম এর সাহিত্যকর্ম
মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও তিনি বিচরণ করেছেন। 

তার সাহিত্যকর্ম গুলো হলো-

  •  অগ্নিবীণা (১৯২২) [প্রথম প্রকাশিত কাব্য]
  • দোলন চাঁপা (১৯২৩)
  • বিষের বাঁশি (১৯২৪)
  • ভাঙ্গার গান (১৯২৪)
  • ছায়ানট (১৯২৫)
  • চিত্তনামা (১৯২৫)
  • পূবের হাওয়া (১৯২৫)
  • সাম্যবাদী (১৯২৫)
  • ঝিঙে ফুল (১৯২৬)
  • সর্বহারা (১৯২৬)
  • ফণিমনসা (১৯২৭)
  • সিন্ধু হিন্দোল (১৯২৭)
  • জিঞ্জীর (১৯২৮)
  • চক্রবাক (১৯২৯)
  • সন্ধ্যা (১৯২৯)
  • প্রলয়শিখা (১৯৩০)
  • নতুন চাঁদ (১৯৩৫)
  • নির্ঝর (১৯৩৫)
  • মরুভাস্কর (১৯৫০)
  • শেষ সওগাত (১৯৫৮)
  • ঝড় (১৯৬০)

উপন্যাস :

  • বাধনহারা (প্রথম উপন্যাস এবং প্রকশিত হয় ১৯২৭ সালে)
  • কুহেলিকা
  • মৃত্যুক্ষুধা


নাটক :

  • ঝিলিমিলি
  • পুতুলের বিয়ে
  • আলেয়া
  • মধুমালা

প্রবন্ধ :

  • যুগবাণী
  • রাজবন্দীর জবানবন্দী
  • রুদ্রমঙ্গল
  • দুর্দিনের যাত্রী

গল্পগ্রন্থ :

  • ব্যথার দান
  • রিক্তের বেদন
  • শিউলিমালা

অনুবাদগ্রন্থ :

  • রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ
  • রুবাইয়াৎ-ই-ওমরখৈয়াম
  • কাব্যে আমপারা

সঙ্গীত পরিচালনা :

  • ধ্রুব
  • গোরা
  • চৌরঙ্গী
  • পাতাল পুরী

গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ 

তার প্রথম কবিতা "মুক্তি" (১৯১৯ সাল)। প্রথম প্রবন্ধ 'তুর্কি মহিলার ঘোমটা খোলা' (১৯১৯ সাল)। তিনি "আনন্দময়ীর আগমনে" কবিতা লেখার কারণে ১৯২২ সালে কারাবরণ করেন। তিনি 'ধূপছায়া ' নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন এবং একটি চরিত্রে নিজেই অভিনয় করেন।

পুরস্কার ও সম্মাননাঃ

কজী নজরুল ইসলাম ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে "জগত্তারিণী স্বর্ণপদক" লাভ  করেন।

১৯৬০ সালে তিনি ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা "পদ্মভূষণ" পদকে ভূষিত হন।

১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। সেই বছরই  তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানসূচক পদক।

সম্প্রতি ২০২২ সাল থেকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩ তম জন্মবার্ষিকী ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি কর্তৃক 'নজরুল পুরস্কার' প্রবর্তন করা হয়। পুরস্কার হিসেবে একটি ক্রেস্ট, সম্মাননা সনদ ও দুই লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়।

উপসংহার :

সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে নজরুল আমৃত্যু সকল অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার, প্রতিবাদী । এজন্য বাংলা সাহিত্যের 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত । আবার একই সঙ্গে কোমল দরদি মন নিয়ে ব্যথিত বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকেছেন তিনি। এক হাতে বাঁশি আরেক হাতে রণতূর্য নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন নজরুল। আর এসেই প্রচলিত শিল্পধারাসমূহকে পাল্টে দিয়ে নতুন বিষয় ও নতুন শব্দে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতকে করেছেন সমৃদ্ধতর ।

দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া নজরুলের কর্মজীবনও ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় । মসজিদের ইমামতি, লেটোর দলে যোগদান, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগদান, রাজনীতি, পত্রিকা সম্পাদনা কিংবা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়াসহ বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবন ছিল পূর্ণ ।

মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় এই ঋদ্ধ ও সম্ভাবনাময় জীবন আমৃত্যু নির্বাক হয়ে যায় । বাংলাদেশ স্বাধীন হলে নাগরিকত্ব এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে অসুস্থ নজরুলকে সসম্মানে এদেশে বরণ করে নেওয়া হয় । এর কিছুকাল পরে কবির মৃত্যু হলে তাঁকে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url